মানসিক স্বাস্থ্যেরও যত্ন নিন

বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী অ্যারন বেকের তত্ত্ব অনুযায়ী, নিজের, পরিবেশের ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার সম্মিলিত প্রকাশ হলো বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশন। বিষণ্নতা এক ধরনের মানসিক রোগ, যা আমাদের স্বাভাবিক কাজকর্মকে বাধাগ্রস্ত করে। রোগ জটিল আকার ধারণ করলে এমনকি রোগীর মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতাও দেখা দিতে পারে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে বিশ্বে এ রোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

অনাকাক্সিক্ষত বিপদ থেকে রক্ষা পেতে বিষণ্নতার কারণগুলো আমাদের সবার জানা থাকা খুবই জরুরি। যেমন-১. জিনগত, ২. পারিবারিক, ৩. কিছু ওষুধ যেগুলো মস্তিষ্কের ওপর প্রভাব ফেলে, তা দীর্ঘমেয়াদি গ্রহণ করা, ৪. কোনো কারণে মানসিক চাপ বাড়লে, বিশেষ করে বিচ্ছেদ, প্রিয়জনের মৃত্যু হওয়া, ৫. দীর্ঘদিন ধরে কঠিন কোনো রোগে ভুগছেন-এমন রোগীদেরও বিষণ্নতায় ভুগতে দেখা যায়।

আমরা যদি কিছু নিয়মকানুন শুরুতেই মেনে চলি, তাহলে হয়তো অতি অল্প সময়েই বিষণ্নতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারব। সেজন্য প্রথমেই যা দরকার তা হলো সদিচ্ছা বা আন্তরিকতা, সেটি অবশ্যই হতে হবে নিজের ও পরিবারের সদস্যদের। বিষণ্নতা থেকে দূরে থাকার জন্য যে বিষয়গুলো আমাদের জানা প্রয়োজন তা নিম্নরূপ-

১. নেতিবাচক চিন্তা দূর করতে হবে, ২. পর্যাপ্ত ঘুম খুবই জরুরি, ৩. সঠিক খাদ্যাভাসের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে, ৪. নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে অথবা নির্দিষ্ট সময় করে হাঁটতে হবে, ৫. সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে জড়িত রাখতে হবে, ৬. নিজেকে সময় দিতে হবে, অর্থাৎ দিনের কোনো নির্দিষ্ট সময় নিজের জন্য রাখতে হবে। নিজের যত্ন নিতে হবে, ৭. পরিবারকে সময় দিতে হবে। অর্থাৎ পরিবারের সবার সঙ্গে খাবার গ্রহণ করা, টিভি দেখা এবং দিনের শেষে গল্প বা আলোচনায় বসা, ৮. আনন্দের উৎস খুঁজতে হবে। যেমন-নতুন কিছু করার চেষ্টা করা, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা, ৯. প্রকৃতির কাছাকাছি যেতে হবে, যা দেবে অনাবিল আনন্দ, ১০. সকালের সূর্যের মিষ্টি আলো নিয়মিত গ্রহণ করতে হবে।

আমাদের সবসময় মনে রাখতে হবে, প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি কখনো এক বিন্দুতে অবস্থান করে না, তাই নিরাশ হওয়া যাবে না, চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। নিজেকে ও পরিবারকে কিছু বিষয়ের ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। যেমন-১. নিজে বা পরিবারের কেউ বিষণ্নতায় ভুগছেন এমন ব্যক্তিকে কখনো অন্যের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না, ২. নেতিবাচক চিন্তা কখনোই করা যাবে না, ৩. নিজেকে কখনোই আত্মীয়স্বজন বা সমাজ থেকে গুটিয়ে রাখা যাবে না, ৪. নিজের একান্ত ব্যক্তিগত কথা আপনজন বা ডাক্তার ছাড়া সবার সঙ্গে শেয়ার করা থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করলে ভালো হয়, ৫. কোনোভাবেই নিজেকে মাদকের সঙ্গে জড়ানো যাবে না, ৬. রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনোভাবেই কোনো ওষুধ গ্রহণ করা যাবে না।

এক গবেষণায় দেখা গেছে, কিছু নিউরোটান্সমিটারের (রাসায়নিক বার্তাবাহক, যার মাধ্যমে মস্তিষ্কের ম্লায়ুগুলোর মধ্যে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়) পরিমাণ কমে যাওয়া ডিপ্রেশনের জন্য দায়ী। প্রাথমিকভাবে দায়ী তিনটি প্রধান নিউরোটান্সমিটার হলো : ১. সেরোটোনিন, ২. নরএপিনেফ্রিন ও ৩. ডোপামিন। এছাড়া আরও কিছু নিউরোটান্সমিটারের ক্ষরণ বা উৎপাদন কমে গেলে মানুষ ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হতে পারে।

বিষণ্নতায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের কিছু উপসর্গ দেখা যায়। যেমন-১. কোনো কাজ করার উৎসাহ বা মনোযোগ হারিয়ে ফেলা, ২. শরীরের ওজন বেড়ে বা কমে যাওয়া, ৩. ঘুমের সমস্যা দেখা দেওয়া বা সারা দিন তদ্রাচ্ছন্ন থাকা, ৪. খাবারে অরুচি তৈরি হওয়া বা রুচি বেড়ে যাওয়া, ৫. ক্লান্ত ভাব বা শক্তিহীনতা অনুভব করা, ৬. নিজেকে মূল্যহীন বা দোষী মনে করা, ৭. সিদ্ধান্তহীনতা বা মনোযোগ কমে যাওয়া, ৮. আত্মহত্যা করার প্রবণতা, ৯. হতাশার প্রবণতা, ১০. বিভিন্ন শারীরিক উপসর্গ দেখা দেওয়া, যেমন-হাত পা জ্বালা করা, কান দিয়ে গরম ধোয়া বের হওয়ার অনুভূতি, ভীষণ মাথা ধরা, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদি।

করোনায় মানসিক স্বাস্থ্যের চরম বিপর্যয় হয়েছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনার প্রথম বছরেই বিষণ্নতাজনিত রোগ পাঁচগুণ এবং উৎকণ্ঠাজনিত রোগ ১০ গুণ বেড়েছে। মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয়ের কারণ তিন ধরনের-বায়োলজিক্যাল, সাইকোলজিক্যাল ও সোশ্যাল। বায়োলজিক্যাল হলো করোনার কারণে ব্রেন আক্রান্ত হতে পারে এবং সে কারণে মানসিক স্বাস্থ্যের বিপর্যয় হতে পারে। কিন্তু করোনায় আক্রান্ত হয়নি এমন মানুষও করোনাকালে কোনো না কোনোভাবে এফেকটেড। সবচেয়ে বেশি মানুষ এফেকটেড হয়েছে অর্থনৈতিকভাবে।

করোনাকালে মানসিক, শারীরিক ও সামাজিক নানা ধরনের চাপ বেড়েছে। এ কারণে আত্মহত্যা বেড়ে গেছে। কেউ আবার পরিবারের সদস্য বা আত্মীয়ের মৃত্যুতে শোকাহত। কাছের মানুষের স্মৃতি কঠিনভাবে তাকে তাড়া করে এবং সেই শোক কোনোভাবেই ভুলতে পারেন না। ফলে স্বাভাবিক কাজকর্মে কোনোভাবেই মনোনিবেশ করা সম্ভব হয় না। মানসিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি শারীরিকভাবে অসুস্থতা বোধ করেন।

করোনায় শিশুদের মনোজগতের ওপর প্রচণ্ড আঘাত পড়েছে। শিশুদের আবেগ ও আচরণ সমস্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। শিশুদের ঘুমের, খেলার, খাবারের, পড়াশোনার সময় বা রুটিন-সব কিছুতেই ব্যাঘাত বা অনিয়ম ঘটেছে। ডিভাইস অ্যাডিকশনে আক্রান্ত হয়েছে অনেক শিশু। কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে বেড়েছে বিষণ্নতার মাত্রা। কোমলমতি শিশুরা সারাক্ষণ চার দেয়ালের মধ্যে বন্দি থাকায় তাদের আচরণগত বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিয়েছে।

আমার ব্যক্তিগত অভিমত হলো, পরিবারের কারও মধ্যে অস্বাভাবিকতা লক্ষ করলে লজ্জা বা অবজ্ঞা না করে কোনো সাইকোলজিস্ট, সাইক্রিয়াট্রিস্ট অথবা রেজিস্ট্রার্ড চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত। প্রতিটি পাড়া-মহল্লা বা ওয়ার্ডে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করা উচিত। পাশাপাশি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কাউন্সেলিং বা মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নের জন্য সরকারি ও বেসরকারিভাবে উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে মনে করছি। একটি সুন্দর আগামীর জন্য মানসিক স্বাস্থ্যের যত্নের কোনো বিকল্প নেই।

Full Video