বডি পজিটিভিটির বাজারমূল্য ৭৫৮ বিলিয়ন ডলার

আপনি ফেসবুকে। স্ক্রল করতে করতে সামনে এল, ‘মেদভুঁড়ি কী করি?’, ‘শরীরের খুঁতগুলো নিমেষেই নিখুঁত করতে প্লাস্টিক সার্জারি’, ‘আরও উজ্জ্বল ত্বক চান? সমাধানের নাম…’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চিত্র অনেকটা একই রকম। গণমাধ্যমেরও তাই। সবখানেই ‘পারফেক্ট শরীর’-এর মাপজোখ, টোন, ইঞ্চিতে ঠিক করে দেওয়া।

একজন মানুষ তাঁর শরীর নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে নাকি হীনম্মন্যতায় ভুগবে, তা অনেকাংশে ঠিক করে দেয় গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ইনফ্লুয়েন্সার আর তারকারা। এসবের বাইরে বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত শরীরের ধারণাও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছে। ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে এই সবকিছুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শরীর নিয়ে হীনম্মন্যতাকে ঠেলে ফেলে সমস্ত শরীরের সৌন্দর্যকে উদ্‌যাপনের যে আন্দোলন, সেটিই ‘বডি পজিটিভিটি মুভমেন্ট’।

আপনার শরীর যেমনই হোক, উচ্চতা চার ফুট বা ছয় দুই, গায়ের রং কালো, সাদা বা বাদামি, চুল কোঁকড়া বা সোজা—আপনি অনন্য। আপনি একজনই। কারও সঙ্গে কারও শারীরিক কোনো তুলনা হয় না। নিজের শরীর নিয়ে গর্ববোধ করুন। সহজভাবে এটাই বডি পজিটিভিটির মূল দর্শন।

সময়ের সঙ্গে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ‘বডি পজিটিভিটি মুভমেন্ট’। এর উদ্দেশ্য যার শরীর যেমনই হোক না কেন, ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে তার গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানো। ‘সব শরীরই সুন্দর’ আর ‘বৈচিত্র্যই সৌন্দর্য’—এমন একটি ধারণা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে এই মুভমেন্ট। ‘মিডিয়ার ঠিক করে দেওয়া সুন্দর শরীরের নির্দিষ্ট কাঠামো’, ‘জিরো ফিগার’—এই সমস্ত ধারণাকে দুমড়েমুচড়ে ছুড়ে ফেলে দেয় বডি পজিটিভিটি। বিজ্ঞাপনে নারীরা যে ধরনের শরীর দেখে, তারা নিজেরাও সেই ধরনের শরীর হলে সুখী হয়। যেটা কেবলই একটা ফ্যালাসি। এটা মানুষের ওপর একটা ধারণাকে চাপিয়ে দিয়ে নানাভাবে ‘টাকা কামানোর ধান্দা’।

দ্য ড্রিম রিভিউয়ের প্রতিবেদন অনুসারে একটি সমীক্ষা বলছে, ১৩ বছর বয়সী মেয়েদের শতকরা ৫৩ ভাগই নিজেদের শরীর নিয়ে অসুখী। আর ১৭ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে সেই অসুখীদের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৮ শতাংশে। ইনস্টাগ্রামে এখন পর্যন্ত হ্যাশট্যাগ দিয়ে দেড় কোটির বেশিবার ‘বডি পজিটিভিটি’ নিয়ে পোস্ট করা হয়েছে। বডি পজিটিভিটির ধারণা বিউটি ইন্ডাস্ট্রিতে যে প্রভাব ফেলেছে, তার বাজারমূল্য (মার্কেট প্রাইস) ২০১৮ সালে ছিল ৫০৭ বিলিয়ন। আর ২০২৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়াবে ৭৫৮ বিলিয়ন। কেননা, তখন সব ধরনের শারীরিক সৌন্দর্যকে আরও বেশি করে ইন্ডাস্ট্রিতে তুলে ধরা হবে। প্রচলিত ধারণার বাইরে যারা, তাদের জন্যও বেশি বেশি ফ্যাশন আর বিউটির পণ্য উৎপাদিত হবে। ফ্যাশন মার্কেট হবে সবার। ৭০ ভাগ কৃষ্ণাঙ্গ একমত পোষণ করেছেন যে বিজ্ঞাপনে তাঁরা কৃষ্ণাঙ্গ মডেল দেখলে নিজেদের সুন্দরী মনে করেন।

মার্কিন সংগীতশিল্পী লিজ্জো বডি পজিটিভিটিকে জনপ্রিয় করে তুলতে দারুণ ভূমিকা রেখেছেন। বিউটি ব্র্যান্ডগুলোও নজর দিচ্ছে এই দিকটাতে। কেবল ফ্যাশন আর স্টাইলই নয়, নেতৃত্বের ধারণাতেও বদল এনেছে বডি পজিটিভিটি। বিউটি বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, ফ্যাশন আর বিউটি ইন্ডাস্ট্রিতে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে বডি পজিটিভিটির ধারণা। কেননা, শরীর বা সৌন্দর্যের যে তথাকথিত ধারণা, বেশির ভাগ মানুষই সেখানে ফিট করে না, সেই ছকে পড়ে না। তাই তারা সেই সব প্রোডাক্ট ব্যবহার করতে উৎসাহিতও হয় না। বডি পজিটিভিটির ধারণা তাই ফ্যাশন আর বিউটি ইন্ডাস্ট্রিতেও ইতিমধ্যে বিক্রি বাড়িয়েছে। মূলধারার বাইরে গিয়ে অনেকেই হচ্ছেন বিভিন্ন বডি পজিটিভ ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর।

বডি পজিটিভিটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে মানসিক স্বাস্থ্য। মানসিকভাবে প্রফুল্ল আর আত্মবিশ্বাসী থাকার, বিশ্বকে আরেকটু সুন্দর জায়গা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বডি পজিটিভিটির কোনো বিকল্প নেই। তাই তো এই মুভমেন্টের একজন নেতা ১৯৯৬ সালে বলেছিলেন, ‘সবাই সুন্দর। নিজের শরীর, চামড়া আর সবকিছুকে ভালোবাসার মাধ্যমেই একজন মানুষের পরিপূর্ণ সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। পৃথিবীতে প্রতিটা মানুষ আলাদা। সেই বৈচিত্র্য উদ্‌যাপন করাই বডি পজিটিভিটির লক্ষ্য।’

Full Video