নিরাপত্তা পরিষদেও চেষ্টা চালাতে হবে

রোহিঙ্গা সংকট অবসানের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে প্রথমবারের মতো একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়েছে। এ প্রস্তাব গ্রহণকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এবং বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক বলছেন বিশেষজ্ঞরা। কারণ, অতীতে অনেক দেশ এ প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দিলেও এবার কেউ বিরোধিতা করেনি। এর পাশাপাশি আরেকটি কারণেও এ প্রস্তাবটি ঐতিহাসিক-মিয়ানমার ইস্যুতে অধিকাংশ সদস্য দেশের সঙ্গে দৃশ্যত দ্বিমত প্রকাশকারী দেশ চীন ও রাশিয়াও অন্যান্যবারের মতো এবার বিপক্ষে দাঁড়ায়নি।

এমন এক সময়ে এ প্রস্তাবটি পাশ হয়েছে, যার কিছুদিন আগে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ৭৬তম সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর প্রতি ‘অতি জরুরি’ ভিত্তিতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন জোরদার করার দাবি জানিয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি সেখানে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার প্রেক্ষাপট তুলে ধরে এ সংকট প্রশ্নে প্রধান আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর নিষ্ক্রিয়তায় বাংলাদেশের মর্মাহত হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে এনে বলেছিলেন-‘গত চার বছর ধরে আমরা এ উচ্চাশাই পোষণ করে আসছিলাম যে, এসব স্থানচ্যুত লোকজন নিজেদের দেশ, তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে নিরাপদে, সুরক্ষিতভাবে, সসম্মানে ফেরত যেতে পারবে। আমরা তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য আন্তর্জাতিক সমাবেশে এবং আন্তর্জাতিক সমাজের প্রতি আস্থা রেখেছিলাম। আমাদের কথা শোনা হয়নি, আমাদের আশা অপূর্ণই থেকে গেছে।’

তিনি আরও বলেছিলেন, প্রত্যাবাসনে অগ্রগতির ঘাটতির কারণে হতাশা বৃদ্ধি পাওয়া রোহিঙ্গাদের অনেকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে এবং তারা অতি সহজে জঙ্গি মতাদর্শের শিকার হচ্ছে। এটি পুরো অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। এ ব্যাপারে অতি দ্রুত কিছু করতে ব্যর্থ হলে সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা মহাবিপদে পড়বে।

মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ আহ্বানের পরই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে গুরুত্ব হারাতে বসা রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান আবারও নতুন করে আলোচনায় আসে। এবং তারপরই সাধারণ পরিষদে সর্বসম্মতভাবে পাশ হলো এ প্রস্তাবটি। কিন্তু এ প্রস্তাব পাশের কারণে মিয়ানমার কতখানি চাপের মুখে পড়ল, এ নিয়ে সন্দেহ কিছুটা রয়েই গেছে। কারণ, সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব দিয়ে কোনো বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। এজন্য প্রয়োজন নিরাপত্তা পরিষদে সর্বসম্মত প্রস্তাব। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এতদিন চীন ও রাশিয়া সেখানে মিয়ানমারের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করার কারণে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা যায়নি। তবে এবার যেহেতু দেশ দুটি সাধারণ পরিষদে বিরোধিতা করেনি, সেহেতু তারা নিরাপত্তা পরিষদের ক্ষেত্রেও হয়তো আগের অবস্থান পর্যালোচনা করতে পারে।

এবার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানের পর একটি জোরালো পদক্ষেপ এলেও প্রশ্ন আসতে পারে, এতদিনেও কেন প্রত্যাশিত সাফল্য আসেনি? এর কারণ হচ্ছে, জাতিসংঘ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো রোহিঙ্গাদের ওপর চলা জাতিগত নিধন নিয়ে সোচ্চার হলেও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলো, যারা রোহিঙ্গা ইস্যুতে মোটা দাগে ভূমিকা রাখতে পারত, তারা বাংলাদেশকে আশ্বাস দিলেও আশানুরূপ সহযোগিতা করেনি।

বিশেষ করে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে মাঠে রেফারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া চীনের ভূমিকা বাংলাদেশকে বরাবরই হতাশ করেছে। দেশটি শুরু থেকেই বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরামে উপস্থাপনের পরিবর্তে দ্বিপক্ষীয় সমাধানের পক্ষে কাজ করেছে। নিরাপত্তা পরিষদে তারা বারবার ভেটো প্রয়োগ করেছে, প্রকাশ্যে বিরোধিতা করেছে। অন্যদিকে, কেবল তাদের আশকারা পেয়েই মিয়ানমার নানা অজুহাতে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া ঝুলিয়ে রেখেছে। এ পর্যায়ে চাপ দিয়ে চুক্তি করিয়েছে, অন্তরালে থেকে প্রত্যাবাসন নাটকও করিয়েছে।

তদুপরি, জাতিসংঘ রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও চীন ও রাশিয়ার ভূমিকার কারণে নিরাপত্তা পরিষদ কোনোরকম ব্যবস্থা নিতে পারেনি। যদিও গাম্বিয়ার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন-নির্যাতনের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শুনানিতে সম্মতি দেয়, তবে হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অন্তর্র্বর্তী আদেশ দেওয়ার সময়টিতে মিয়ানমারকে সাহস জোগাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দেশটি সফর করেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।

অন্যদিকে, এ অঞ্চলের অন্যান্য দেশের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টায় চীনের পাশাপাশি ভারতও সম্প্রতি এক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। এটিও আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছে। এর ফলে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের মতো ভারতের মতো বন্ধু দেশকেও কখনো পাশে পায়নি বাংলাদেশ। এদিকে, বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে সৃষ্ট নতুন ভূ-রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের কারণে চীনও মিয়ানমারের ওপর নির্ভরতা দিন দিন বাড়িয়েছে। বিশ্বে প্রভাব বিস্তারে চীনের বিআরআই প্রকল্পের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ ধরা হয় মিয়ানমারকে। এটা হচ্ছে ভারত মহাসাগরে চীনের প্রবেশদ্বার। এর বিনিময়ে মিয়ানমার যা চেয়েছে, তা-ই দিয়েছে চীন।

বলা হচ্ছে, চীনা অর্থনীতির লাইফলাইন হয়ে উঠতে পারে এ প্রবেশদ্বার। এসবের মাধ্যমে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং বঙ্গোপসাগরে অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির ভারসাম্য চীনের পক্ষে রাখা হবে। এসব হিসাব-নিকাশের কারণে মিয়ানমারও হয়তো ভেবেছে, প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত করতে পারলেই রোহিঙ্গা সংকটের ওপর থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ কমে যাবে। এ কারণে তারা দিনের পর দিন ছলচাতুরী করে গেছে।

চীন তার ভূ-রাজনীতির স্বার্থে উত্তর কোরিয়ার মতো মিয়ানমারকেও যা খুশি তা করার লাইসেন্স দিয়ে দিলেও মিয়ানমার ধীরে ধীরে পশ্চিমাদের সঙ্গেও সখ্য বাড়িয়েছে। মিয়ানমারের এ চালাকি চীন-রাশিয়া বুঝতে পারছে। বাংলাদেশের জোরদার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং চীনের এ বোধোদয়ের সম্ভবত যোগফলই হচ্ছে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে চীনের বিরোধিতা না করা। আর মিয়ানমার প্রসঙ্গে চীন যেদিকে, রাশিয়াও সেদিকে এ নীতির কারণে রাশিয়াও বিরোধিতা করেনি। তবে বাংলাদেশকে এটুকুতে সন্তুষ্ট থাকলে চলবে না। চীন ও রাশিয়ার এ পদক্ষেপ তখনই ইতিবাচক হিসাবে গণ্য হবে, যখন নিরাপত্তা পরিষদেও দেশ দুটি একই অবস্থান ধরে রাখবে।

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আগ্রহ কমেনি বরং তারা আগের চেয়ে আরও বেশি জোরালোভাবে এ বিষয়ে প্রস্তাব গ্রহণ করেছে। এখন চীন, রাশিয়াসহ ভারতের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলোও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের পক্ষে যাতে কাজ করে, সে কৌশল নিতে হবে। এর পাশাপাশি নিরাপত্তা পরিষদেও সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য জোর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালাতে হবে। কূটনৈতিক প্রক্রিয়া জোরদার করতে হবে। হুট করেই কোনো রেজুলেশন আনা যাবে না। সবার সঙ্গে কথা বলে তবেই এগোতে হবে। কারণ নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব গৃহীত না হলে সাধারণ পরিষদে গৃহীত প্রস্তাব মিয়ানমার সরকারের কাছে অতীতের মতোই গুরুত্বহীন বলে বিবেচিত হবে।

Full Video