নরসুন্দর শেফালীর পেশার লড়াই

নরসুন্দর শেফালী রানী। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে হয়ে যায়। পরে সংসারে জন্ম নেয় একে একে চার ছেলে ও এক মেয়ে। স্বামী বিশ্বনাথ শীলও ছিলেন নরসুন্দর। জীবনের ঘানি টানতে টানতে খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে হয়ে যান নিরুদ্দেশ। এ অবস্থায় সন্তানদের নিয়ে ভীষণ অসহায় হয়ে পড়েন শেফালী। সংসারের হাল ধরতে পরে তিনি নিজেও বেছে নেন স্বামীর পেশা। এই সাহসী কাজের জন্য পেয়েছেন জয়িতা সম্মাননা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপহার দিয়েছেন এক টুকরা জমি ও ঘর।

ঝালকাঠির কাঁঠালিয়া উপজেলার বলতলা দোগনা বাজারে নরসুন্দরের কাজ করেন শেফালী রানী। নারী হয়ে পুরুষের চুল-দাড়ি কেটে বিপুল আলোচনার জন্ম দেন। স্বল্প সময়ে অনেক কিছু পেয়েও যান। কিন্তু যে কাজের জন্য তিনি এত কিছু পেয়েছেন, সেই নরসুন্দর পেশা টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কারণ, তাঁর স্থায়ী কোনো দোকান ঘর নেই। অন্যের ঘরের বারান্দার সামনে খোলা আকাশের নিচে পেশা অব্যাহত রাখার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন শেফালী। তাঁর সেই সংগ্রামে বাগড়া বসাচ্ছে বৃষ্টি। বৃষ্টির কারণে প্রায়ই কাজ বন্ধ রাখতে হচ্ছে। ফলে কমে যাচ্ছে উপার্জন।

তবে দমবার পাত্র নন শেফালী। বৃষ্টির কারণে যখন নরসুন্দরের কাজ বন্ধ থাকে তখন দোগনা বাজারে সকালে হোটেলে হোটেলে খাবার পানি সরবরাহ করেন। আর দুপুরে পানের বরজে কাজ করেন। এরপর হাতে যদি একটু সময় থাকে বাগান থেকে কুড়িয়ে নেন পড়ে থাকা সুপারি। আবার কখনো কখনো সনাতন ধর্মাবলম্বীদের জন্ম, মৃত্যু, বিয়েতে রীতি মেনে কাজ করেন। এই বহুমুখী আয় দিয়ে কোনো মতে সাত সদস্যের সংসার টেনে নেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন।

শেফালীর শুরুটা মোটেও সুখকর ছিল না। দোগনা বাজারে স্বামী বিশ্বনাথ শীলের সেলুন ছিল। অন্যের চুল-দাড়ি কেটে স্বামী যা আয় করতেন, তা দিয়ে কোনো রকমে চলত সংসার। কিন্তু ১৫ বছর আগে জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন বিশ্বনাথ। বন্ধ হয়ে যায় শেফালীর সংসারের চাকা।

নিজের চিকিৎসা ও সংসারের খরচ বহন করতে না পেরে নিরুদ্দেশ হয়ে যান বিশ্বনাথ। শেফালী কখনো ভাবেননি পুরুষের চুল-দাড়ি কেটে তাঁকে সংসার চালাতে হবে। কিন্তু জীবনের প্রয়োজনে অন্যের চুল-দাড়ি কেটে বর্তমানে সংসার ও পাঁচ সন্তানের পড়ালেখার খরচ বহন করছেন শেফালী। এর মধ্যে মেয়ে বিএ পড়ছে। ছেলেরাও পড়ালেখা করছে। আর প্রতিদিন সকালে শেফালী চুল-দাড়ি কাটার যন্ত্রপাতি নিয়ে হাজির হন দোগনা বাজারে। সেখানে এক প্রবাসীর বসতঘরের বারান্দার সামনে খোলা আকাশের নিচে দিনভর কাজ করেন নরসুন্দর শেফালী।

স্থানীয়রা জানান, শেফালীর শুরুটা ছিল ভীষণ চ্যালেঞ্জের। স্বামী নিরুদ্দেশ হওয়ার পর ছেলেমেয়ে নিয়ে অথই সাগরে পড়েন তিনি। নিরুপায় হয়ে সিদ্ধান্ত নেন স্বামীর পেশা গ্রহণের। বাজারে পুরুষের চুল-দাড়ি কাটার কাজ শুরু করলে বাধা আসে। তবে এলাকাবাসীর হস্তক্ষেপে সেই বাধা দূর হয়। এখন অনেকে তাঁর প্রশংসা করছেন। নারী হয়ে পুরুষের সৌন্দর্যবর্ধনের সাহসী পদক্ষেপ নেওয়ায় জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ২০১৮ সালে শেফালীকে জয়িতা সম্মাননা দিয়েছে।

শেফালী রানী বলেন, ‘নারী হয়ে পুরুষের চুল কাটি, এটা নিয়ে প্রথমে মানুষ হাসাহাসি করত। মনে মনে ভয় পেতাম যাদের চুল কাটছি তাদের কেমন দেখাবে! তবে ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে গেছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘গ্রামের বাজারে প্রতিদিন ৫০ থেকে ১০০ টাকা আয় হয়। হাটের দিন আরেকটু বেশি। মাঝে মাঝে গ্রাহক থাকে না। তখন বাজারের বিভিন্ন দোকানে পানি সরবরাহের কাজ করি। এতে একটু বাড়তি আয় হয়।’

বলতে বলতে শেফালী একটু থামেন। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে ম্লান মুখে বলেন, ‘আমার নিজের কোনো জায়গা নেই। অন্যের বাড়ির বারান্দার সামনে সেলুন দিয়েছি। বৃষ্টির সময় সেখানে কাজ করা যায় না। প্রধানমন্ত্রী আমাকে ৫ শতাংশ জমি ও ঘর দিয়েছেন। সেখানে ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকি। আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু কাজের জন্য আমার একটা স্থায়ী দোকানঘর দরকার। অনেককে অনুরোধ করেছি, এখনো ব্যবস্থা হয়নি।’

কাঁঠালিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুফল চন্দ্র গোলদারের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘নরসুন্দর শোফালী রানীকে প্রধানমন্ত্রী জমিসহ ঘর উপহার দিয়েছেন। তাঁকে কাজের জন্য একটি দোকানঘরও দেওয়া হবে। স্থানীয় নির্বাচন এবং করোনার কারণে একটু বিলম্ব হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা শেফালীকে দোকানঘরের ব্যবস্থাও করে দেব।’

কাঁঠালিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান এমাদুল হক মনির বলেন, শেফালী রানীকে দোকানঘর নির্মাণ করে দেওয়া হবে। যাতে করে শেফালী তাঁর পেশায় থাকতে পারেন।

Full Video