শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি

করোনার কারণে প্রায় দেড় বছর বন্ধ থাকার পর দেশের স্কুল ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে বলেছেন, খুব তাড়াতাড়ি স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার জন্য তিনি নির্দেশ দিয়েছেন। সে অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে।

স্কুলগুলোতেও খোলার প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। শিক্ষা প্রশাসন স্কুল কর্তৃপক্ষকে মৌখিকভাবে খোলার প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বলেছে। কী প্রস্তুতি নিতে হবে, তা গত ফেব্রুয়ারিতেই জানানো হয়েছিল। ঢাকাসহ দেশের সাতটি বিভাগের ১০টি স্কুলে সরেজমিন পরিদর্শন করে গত মঙ্গলবার ও বুধবার দেখা যায়, ৮টি স্কুল কমবেশি প্রস্তুতি নিয়েছে। দুটি পিছিয়ে।

যেমন রাজধানীর হাজারীবাগ বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে গত বছরের জুলাইয়ে দেখা গিয়েছিল, ভবনের আঙিনায় শেওলা জমেছে এবং ঘাস উঠেছে। গত মঙ্গলবার গিয়ে দেখা যায়, সবকিছু পরিষ্কার করা হয়েছে। হাত ধোয়ার জন্য রাখা হয়েছে তরল সাবান (হ্যান্ডওয়াশ) ও পানি।

এই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪৪০। স্কুলটির প্রধান শিক্ষক শেখ মোহাম্মদ ছায়িদ উল্লা বলেন, যেকোনো সময় বিদ্যালয় খোলার ঘোষণা আসতে পারে—এমনটি ধরে নিয়ে তাঁরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাঁরা তাপমাত্রা মাপার যন্ত্র কিনেছেন। মাস্ক কেনার উদ্যোগ নিয়েছেন। আরও কিছু প্রস্তুতির বিষয় আছে, যা স্কুল খোলার আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর নেওয়া হবে।

তবে ভিন্ন চিত্র কুষ্টিয়ার মেহেরপুর উপজেলার মেহেরপুর সরকারি বালক বিদ্যালয়ে। গত মঙ্গলবার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, টেবিলগুলোয় ধুলার স্তর। দীর্ঘদিন ধরে নল থেকে চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ে মেঝেতে ময়লা জন্মেছে। বিদ্যালয়টির জ্যেষ্ঠ সহকারী শিক্ষক নাসির উদ্দিন বললেন, এক মাস আগে বিদ্যালয়টিতে পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম চালানো হয়েছিল। সরকারি নির্দেশনা পেলে আবারও শ্রেণিকক্ষগুলো ধোয়ামোছার কাজ করা হবে।

মেডিকেল কলেজ খুলছে ১৩ সেপ্টেম্বর। বিশ্ববিদ্যালয়ে সশরীর পরীক্ষা চলছে। গতরাতে করোনাসংক্রান্ত কমিটির বৈঠকে খোলার পক্ষে মত।
দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে। গত ২৪ আগস্ট প্রকাশিত জাতিসংঘ শিশু তহবিল বা ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কোভিড-১৯-এর কারণে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে স্কুল বন্ধ থাকা দেশের মধ্যে বাংলাদেশ দ্বিতীয়।

এমন পরিস্থিতিতে গত ফেব্রুয়ারিতে এক দফা স্কুল খোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তখন দেওয়া নির্দেশিকায় স্কুল খোলার ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম মানতে বলা হয়—১. শ্রেণিকক্ষে বেঞ্চ সাজাতে হবে ৩ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে। ২. ৫ ফুটের কম দৈর্ঘ্যের বেঞ্চে একজন শিক্ষার্থী এবং ৫ ফুটের বেশি দৈর্ঘ্যের বেঞ্চে দুজন শিক্ষার্থী স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্লাস করতে পারবে। ৩. স্কুলে ঢোকার আগেই তাপমাত্রা পরীক্ষা করতে হবে। ৪. সবার জন্য মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক ইত্যাদি।

এখন স্কুলগুলোকে আগের নির্দেশনা মেনে খোলার প্রস্তুতি নিতে মৌখিক নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) শাহেদুল খবীর চৌধুরী গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, যেকোনো নির্দেশনা যাতে দ্রুত বাস্তবায়ন করা যায়, তার প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বলা হয়েছে।

কবে খুলবে

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে মেডিকেল কলেজসহ চিকিৎসাশিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো খোলার সম্ভাব্য একটি তারিখ পাওয়া গেছে। গতকাল স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, চিকিৎসাশিক্ষার শ্রেণিকক্ষে ক্লাস শুরু হবে ধাপে ধাপে। এর মধ্যে মেডিকেল কলেজের প্রথম, দ্বিতীয় ও পঞ্চম বর্ষের ক্লাস শুরুর সম্ভাব্য তারিখ ঠিক করা হয়েছে ১৩ সেপ্টেম্বর।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গত ২৬ আগস্ট একটি সভা হয়। এতে নেওয়া পরিকল্পনা হলো টিকা দেওয়া সাপেক্ষে আগামী ১৫ অক্টোবরের পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলতে পারবে। যদিও কোনো বিশ্ববিদ্যালয় খোলার সুনির্দিষ্ট তারিখ এখনো জানায়নি। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়েছিল, অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে স্নাতক চতুর্থ বর্ষ ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হতে পারে। অবশ্য ইউজিসির নির্দেশনা অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কিছু কিছু পরীক্ষা সশরীরে নেওয়া শুরু হয়েছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, করোনার সংক্রমণের হার ৫ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে থাকলে স্কুল খোলা যায় কি না, সে বিষয়ে করোনাসংক্রান্ত কারিগরি পরামর্শক কমিটির পরামর্শ চাওয়া হয়েছে। মতামত কী হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে গতরাতে বৈঠক করেছে পরামর্শক কমিটি। বৈঠক শেষে মধ্যরাতে কমিটির সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা প্রথম আলোকে বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এবং জনস্বাস্থ্যবিষয়ক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা সাপেক্ষে এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া যায়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, তাদের ভাবনা হলো চলতি মাসে অষ্টম, দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির মতো পাবলিক পরীক্ষা-সংশ্লিষ্ট নির্ধারিত কিছু শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে ক্লাস শুরু করে স্কুল খুলে দেওয়া। পরে ধাপে ধাপে অন্যান্য শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষে আনা হবে।

আগামী রোববার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে আন্তমন্ত্রণালয় সভা ডেকেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হচ্ছে এটি ভালো দিক। খোলার পরই শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি পূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি ঝরে পড়া রোধে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে বাস্তবায়ন করতে হবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আলোচনার মধ্যে মাঠপর্যায়ে প্রস্তুতি দেখতে গত মঙ্গলবার ও বুধবার ১০টি স্কুলে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে সরেজমিন পরিদর্শন করা হয়। এতে দেখা যায়, স্কুলগুলো মূলত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা, মাস্ক কেনা এবং তাপমাত্রা মাপার প্রস্তুতি নিয়েছে অথবা নিচ্ছে। কোন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে কোন দিন শ্রেণিকক্ষে আনা হবে, পালা কী হবে, বেঞ্চ সাজানোর পরিকল্পনা—এসব নেওয়া হবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা পাওয়ার পর।

যেসব স্কুল প্রস্তুতি মাত্র শুরু করেছে, তার একটি ঢাকার সেগুনবাগিচা হাইস্কুল। গত মঙ্গলবার দুপুরে স্কুলটিতে প্রবেশ করেই দেখা গেল, মাঠে বড় বড় ঘাস। তবে একাংশের ঘাস কাটা হয়েছে। শ্রেণিকক্ষগুলো মোটামুটি পরিষ্কার। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক এ কে এম ওবাইদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক দিনের মধ্যেই পুরো মাঠের ঘাস কেটে ফেলা হবে।

রাজধানীর গবর্ণমেন্ট ল্যাবরেটরি হাইস্কুলে গিয়ে গত বুধবার দেখা যায়, নির্ধারিত অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে অভিভাবকদের সঙ্গে কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থীও এসেছে। বিদ্যালয়ের আঙিনা পরিষ্কার। প্রধান শিক্ষক মো. আবু সাঈদ ভূঁইয়া বলেন, তাঁরা দুই ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন। প্রথমত, সরকার যেভাবে বলবে সেভাবেই বসার ব্যবস্থা করা হবে। দ্বিতীয়ত, তাঁরা নিজেরাও বিকল্প একটি চিন্তা করে রেখেছন। সেটি হলো একটি শ্রেণির শিক্ষার্থীর সবাইকে একসঙ্গে না এনে দুই ভাগ (জোড়-বিজোড় ক্রমিক নম্বর অনুযায়ী) করে ক্লাসে আনা। স্বাস্থ্যবিধির অন্যান্য প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছেন।

রাঙামাটির কাপ্তাই নারানগিরি সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে মঙ্গলবার দেখা যায়, অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে ফরম পূরণ ও অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে এসেছে। অধিকাংশের মুখে মাস্ক নেই। কোনো কোনো শিক্ষকও মাস্ক পরা ছাড়া ছিলেন। বিদ্যালয়ের শৌচাগারগুলো ছিল স্যাঁতসেঁতে।

তবে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক মো. জাহাঙ্গীর আলম মনছুরী বলেন, তাঁরা ফেব্রুয়ারি থেকে এক সপ্তাহ পরপর শ্রেণিকক্ষগুলো পরিষ্কার করাচ্ছেন।

ময়মনসিংহের সুপরিচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়। গত মঙ্গলবার গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের আটটি স্থানে বসানো হয়েছে পানির কল। সেখানে রাখা আছে সাবান। দেয়ালে সচেতনতামূলক পোস্টার লাগানো হচ্ছে। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক নাছিমা আক্তার বলেন, স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ে করণীয় নিয়ে একটি তথ্যচিত্র শিগগির শিক্ষার্থীদের দেখানো হবে।

এ ছাড়া নীলফামারী সদর উপজেলার পলাশবাড়ি ইউনিয়নের পলাশবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ জেলার দুটি বিদ্যালয়, সিলেট সদর উপজেলার মেজরটিলা এলাকার দেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে বিভিন্ন রকমের প্রস্তুতির তথ্য পাওয়া গেছে। তবে নাটোর সরকারি বালক উচ্চবিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, প্রধান ফটকে দাঁড়িয়ে আছেন কিছু শিক্ষক ও শিক্ষার্থী। প্রবেশমুখের রাস্তায় পানি। মাঠেও পানি। যাতায়াতে এ সমস্যা থাকলেও খোলার পর পাঠদানে সমস্যা হবে না বলে দাবি করেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক হারুণ অর রশিদ।

এদিকে শ্রেণিকক্ষ, শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ অন্যান্য জনবলের সমস্যাসহ নানামুখী সীমাবদ্ধতার কারণে স্বাস্থ্যবিধি মানা এবং অন্য পরিকল্পনাগুলো ঠিকমতো বাস্তবায়ন করা যাবে কি না, তা নিয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দেখছেন বিভিন্ন শিক্ষকেরা।

স্কুলশিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার চিন্তা

দেশে বর্তমানে ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সীদের টিকা দেওয়া হচ্ছে। এখন ১৮ বছরের কম বয়সী শিক্ষার্থীদেরও টিকা দেওয়ার চিন্তা করছে সরকার। গতকাল সচিবালয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংবাদিকদের বলেন, ‘ফাইজার ও মডার্নার টিকা যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে শিশুদের দেওয়া হয়েছে। তারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এটা দিচ্ছে। সে কারণেই আমাদের দেশেও দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছি।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের কত শিক্ষার্থীকে টিকা দেওয়া হয়েছে তার তথ্য ৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে জানাতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বলা হয়েছে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সচিব ফেরদৌস জামান।

মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, প্রাথমিকের শিক্ষকদের মধ্যে টিকা দেওয়ার হার প্রায় ৮৫ শতাংশ। মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও বেশির ভাগকে টিকা দেওয়া হয়েছে।

সার্বিক বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক এস এম হাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হচ্ছে এটি ভালো দিক। খোলার পরই শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি পূরণের ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি ঝরে পড়া রোধে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে বাস্তবায়ন করতে হবে।

Full Video