রোহিঙ্গা সংকট প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনাও নেই

মানবিক কারণে আশ্রয় দিলেও শুরু থেকেই বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিল যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু করা। এ লক্ষ্যে ২০১৭ সালের নভেম্বরে মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চুক্তি সই করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু এর পরের বাস্তবতা হচ্ছে, একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো যায়নি। শিগগিরই প্রত্যাবাসন শুরু হবে এমন কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। গত সাত মাসে বিষয়টি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনাও হয়নি। পাশাপাশি রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের মূল হোতা জেনারেল মিন অং লায়েং এখন দেশটির সেনা শাসন ও স্বঘোষিত প্রধানমন্ত্রী। সম্প্রতি চীনের একটি টিভিতে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় গতি আনতে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের আগ্রহে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় যুক্ত হয় চীন। শুরু হয় বাংলাদেশ-চীন-মিয়ানমার ত্রিপক্ষীয় আলোচনা। চীনের মধ্যস্থতায় দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক মিলিয়ে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বেশ কয়েকটি হয়। এরপর গত ফেব্রুয়ারি মাসে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পর প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা বন্ধ হয়ে গেছে। আবার এককভাবে চীনকে যুক্ত করায় জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য বৃহৎ শক্তিগুলোও আগেই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া থেকে কিছুটা দূরে ছিল। শুরু থেকেই প্রত্যাবাসনের আলোচনার যুক্ত থাকার চেয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জীবনমান উন্নয়নেই তাদের সব মনোযোগ।

এমন এক প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা ঢলের চতুর্থ বার্ষিকী পালিত হবে আজ ২৫ আগস্ট। রাখাইনের মানচিত্র থেকে রোহিঙ্গাদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চার বছর আগের ঠিক এই দিনে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছিল মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টে শুরু হওয়া ওই সেনা অভিযানের পরের পাঁচ মাসের মধ্যে ৭ লাখের বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আর আগে থেকেই অবস্থান করছিল প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা। এখন পুরোনো ও নতুন মিলিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১১ লাখ।

২০১৯ সালের আগস্টে দ্বিতীয় দফা রোহিঙ্গারা প্রত্যাবাসনের দিনক্ষণ ভেস্তে যাওয়ার পর কক্সবাজারের শিবিরে থাকা রোহিঙ্গা রাখাইনে ফিরতে পাঁচ দফা শর্ত দিয়েছিল। এর মধ্যে রয়েছে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব দেওয়া, রাখাইনে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ভিটেমাটি ফিরিয়ে দেওয়া, ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং হত্যা ও নির্যাতনকারীদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার। এখন পর্যন্ত এসব প্রতিশ্রুতির বিষয়ে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

চীনের সরাসরি মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের তারিখ ঠিক করেছিল। এ জন্য কক্সবাজারের শিবিরে গিয়ে রোহিঙ্গাদের বুঝিয়েছিলেন চীনের কর্মকর্তারা। তালিকাও করা হয়েছিল। কিন্তু রাখাইনের পরিবেশ অনুকূল না থাকা এবং নাগরিকত্বসহ রোহিঙ্গাদের দেওয়া শর্তগুলো পূরণ না হওয়ায় তারা শেষ মুহূর্তে কেউ রাখাইন যেতে রাজি হয়নি। এর আগে ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রথম তারিখ ঠিক করেছিল বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। সেটিও ব্যর্থ হয়।

২০১৭ সালের নভেম্বরে চুক্তি সইয়ের পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ এ পর্যন্ত আট দফায় মিয়ানমারের কাছে ৮ লাখ ৩০ হাজার জনের তালিকা দিয়েছে। এর মধ্যে মিয়ানমার মাত্র ৪২ হাজার রোহিঙ্গার তালিকা যাচাই-বাছাই শেষে ফেরত দিয়েছে। আবার এ তালিকাও অসম্পূর্ণ। কারণ, একই পরিবারের সবার নাম তালিকায় নেই। ফলে এ ধরনের বিচ্ছিন্ন তালিকা দিয়ে কত রোহিঙ্গাকে পাঠানো যাবে, সেই প্রশ্ন রয়েই থাকছে।

অবশ্য রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের ক্ষেত্রে প্রত্যাবাসনের ছবিটা নিরাশার হলেও রাখাইনে গণহত্যার জবাবদিহি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে আশাবাদী হওয়ার কিছু ঘটনা দেখা যাচ্ছে। রাখাইনের ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট–পরবর্তী ‘জাতিগত নিধনের’ ঘটনায় এরই মধ্যে নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজেতে) গণহত্যার বিচার শুরু হয়েছে। আর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) রাখাইনের নৃশংসতার তদন্ত শুরু হয়েছে। একই সঙ্গে আর্জেন্টিনার সুপ্রিম কোর্টে দায়ের করা এক মামলায় নৃশংসতার শিকার হওয়া রোহিঙ্গারা প্রথমবারের মতো সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ ছাড়া মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্যের সরকার (এনএইউজি) নামে পরিচিত বিকল্প বা নির্বাসিত সরকার গত দুই দশকে রোহিঙ্গাসহ মিয়ানমারের বিভিন্ন গোষ্ঠীর ওপর যত আন্তর্জাতিক অপরাধ হয়েছে, এসবের বিচারে তারা আইসিসির এখতিয়ার মেনে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং কূটনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চার বছর পূর্তিতে এসে এটা স্পষ্ট যে মিয়ানমারের সংখ্যালঘু মুসলমানদের রাখাইনে ফেরত পাঠানো শুরুর কোনো সম্ভাবনা এই মুহূর্তে নেই। মিয়ানমারের সামরিক শাসন,আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় থাকার পর এ অঞ্চলসহ ভূরাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের বিষয়টি আন্তর্জাতিক মনোযোগের কেন্দ্রে এখন আর নেই। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সামনে এখন রোহিঙ্গা সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে জোর দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নেই। রোহিঙ্গা সংকট দক্ষিণ এশিয়াসহ এ অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার জন্য বড় ঝুঁকি—বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে সামনে নিয়ে আসতে হবে বাংলাদেশকে। এর পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসনের জন্য এককভাবে চীনের ওপর নির্ভর না করে জাতিসংঘসহ আঞ্চলিক বিভিন্ন পক্ষকে সঙ্গে নিতে জোরালো কূটনৈতিক প্রচেষ্টা দরকার। প্রত্যাবাসন এবং রাখাইনে গণহত্যার জবাবদিহি নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পক্ষের উদ্যোগে বাংলাদেশের সক্রিয় যুক্ততা জরুরি।

কূটনীতিকেরা বলছেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমার পৃথকভাবে জাতিসংঘের সঙ্গে দুটি চুক্তি সই করেছে। এর মধ্যে মিয়ানমার জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচিকে (ইউএনডিপি) যুক্ত করে রাখাইনে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করেছিল। কিন্তু চার বছর পেরিয়ে গেলেও জাতিসংঘ সেখানে সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছে। শুধু স্থানীয় জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের জন্য কয়েকটি প্রকল্প নিয়েছে।

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের বিষয়ে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন প্রথম আলোকে বলেন, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ, ফিলিস্তিনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শরণার্থী সমস্যার সমাধানে দীর্ঘ সময় লেগেছে। রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, মর্যাদার সঙ্গে ও নিরাপদে রাখাইনে ফেরত পাঠানো বাংলাদেশের মূল লক্ষ্য। রাখাইনে গিয়ে যদি তাদের আবার শিবিরে থাকতে হয়, তাহলে রোহিঙ্গারা ফিরতে উৎসাহিত হবে না। তিনি বলেন, মিয়ানমারের নির্বাসিত সরকার আইসিসির এখতিয়ার মেনে নেওয়ার যে ঘোষণা দিয়েছে, সেটা রাখাইনে নৃশংসতার জবাবদিহি নিশ্চিতের ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ। তাদের অবস্থান মিয়ানমারের সামরিক সরকারের জন্য চাপ তৈরি করবে।

রাখাইন পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে

মিয়ানমারে সামরিক শাসন শুরুর পর রাখাইনের নিরাপত্তাসহ সামগ্রিক পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে গেছে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি সন্ধ্যা হলেই পুরো রাখাইন রাজ্য নিয়ন্ত্রণে নেয়। তারা দিনের বেলাতেও রাজ্যের বেশ কিছু এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। গত বছরের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সেনাদের তুমুল লড়াই হয়েছে। সেনা শাসন শুরুর পর রাখানাইনে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কম। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়ে আরাকান আর্মির মনোভাব কী, সেটি জানাও এখন গুরুত্বপূর্ণ।

এর মধ্যে আফগানিস্তান তালেবানের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার পর আঞ্চলিক ও ভূরাজনীতিতে রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি আড়ালে চলে গেছে। কূটনীতিকেরা বলছেন, বিশ্ব মনোযোগও এখন আফগানিস্তানের দিকে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা ইস্যু বিশ্ব মঞ্চে তুলে ধরতে কূটনৈতিক দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে বাংলাদেশকে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা সংকটের দ্রুত সমাধান না হলে সেটি আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য বড় ঝুঁকির কারণ হয়ে উঠবে—বিষয়টি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে জোরালোভাবে তুলে ধরতে হবে।

সমাধান বহু দূরে

কূটনীতিকেরা মনে করেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বাংলাদেশের প্রতি যতটা যৌক্তিক ও সহানুভূতিশীল আচরণ করা উচিত, সেটি তারা করছে না। বরং বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নানা পরামর্শ দিচ্ছে। কক্সবাজারের শিবির থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরে বাংলাদেশের উদ্যোগকে প্রথমে ভালোভাবে নেয়নি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। এখন আবার তারা বলছে, কক্সবাজারেও ভাসানচরের মতো সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এটা মোটামুটি স্পষ্ট, লম্বা সময়ের জন্য রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে থেকে যাবে।

সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের জটিল সমস্যা সমাধানে ধৈর্যের পরিচয় দিতে হয়। আবার নানা ধরনের বিকল্প নিয়ে কাজও চালিয়ে যেতে হয়। রোহিঙ্গা গণহত্যা নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে জবাবদিহির ক্ষেত্রে যে বিষয় এখন সামনে আসছে তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এই প্রক্রিয়া মিয়ানমারের ওপর চাপ তৈরি করবে। এর সঙ্গে প্রত্যাবাসন শুরু করা না গেলে কী ধরনের নিরাপত্তাঝুঁকি এ অঞ্চলের জন্য তৈরি হবে, তা জোরালোভাবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরতে হবে বাংলাদেশকে। পাশাপাশি চীন, ভারতসহ আঞ্চলিক শক্তিগুলোকে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের পক্ষে যাতে কাজ করে, সে কৌশল নিতে হবে।

Full Video