ভালোবাসা আসলে এমনই

৮০ বছর বয়সেও প্রতিদিনের মতো আজ সকালে সাইমন তার স্ত্রী গুনিলার জন্য এক কাপ কফি বিছানার পাশে এনে আস্তে আস্তে ডাকছে, গুনিলা, তোমার জন্য কফি এনেছি। গুনিলা এ প্রথম সাইমনের নিজ হাতে তৈরি কফি মুখে দিতে পারেনি। গুনিলা কখন হঠাৎ ঘুমিয়ে গেছে শান্ত হয়ে, সাইমন তা বুঝতে পারেনি। সাইমন সর্বহারা, কারণ তাদের ৬২ বছরের ভালোবাসার সংসারে হয়নি কোনো নতুন অতিথির আগমন। বহু বছর আগে গুনিলার সঙ্গে সাইমনের দেখা হয়েছিল সুইডেনের ছোট্ট একটি লেকের ধারে। চিত্রশিল্পী সাইমন লেকের ধারে বসে গুনিলার পুরো দেহটার চিত্রাঙ্কন করেছিল একটি পাথরের ওপর। গোসল শেষে উঠতে পথে গুনিলার নজর কেড়ে নিয়েছিল এই সুদর্শন চিত্রশিল্পী সাইমন।

গুনিলা একজন স্কুলশিক্ষক, সে সাইমনের আঁকা নিজের ছবিটি দেখে মুগ্ধ হয় এবং সাইমনের হাত ধরে সেই যে তার প্রেমে বন্দী হয়েছে, আর কোনো দিন মুক্তি পায়নি। তবে তাদের বিয়ের পর একবার সংসারে ঝড় উঠেছিল বিচ্ছেদের।

গুনিলা সাইমনের জীবন থেকে সরেও গিয়েছিল। ওই যে কথায় বলে, ভাগ্যের লিখন না যায় খণ্ডন! ঠিক তেমনটি ঘটেছিল তাদের জীবনে। গুনিলা স্কুলশিক্ষক, ক্লাসে একটি ছেলে প্রতিদিনই দেরি করে আসে, বেশ অমনোযোগী। মাঝেমধ্যে সে ঘুমিয়ে পড়ে বেঞ্চের ওপর। ক্লাসের কেউই ছেলেটিকে পছন্দ করে না বললেই চলে। গুনিলা সিদ্ধান্ত নেয় ছেলেটির মা–বাবার সঙ্গে দেখা করার। সে একজন শিক্ষক হিসেবে মনে করে এটা তার নৈতিক দায়িত্ব। যে কথা সেই কাজ। ক্লাস শেষে ছেলেটিকে সঙ্গে নিয়ে তার বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেয়। যেতে যেতে পথে অনেক পারিবারিক বিষয়ে আলোচনা হয় দুজনার মধ্যে।

ও, ছেলেটির নাম ডেনিয়েল, বয়স আট বছর। মা মারা গেছে জন্মের পর, বাবা নতুন করে বিয়ে করেছে। সংসারে ডেনিয়েল একটি বোঝা, কিন্তু দায়ভার এড়ানোর উপায় না থাকার কারণে ডেনিয়েলকে তারা যতটুকু না করলেই নয়, তার বেশি কিছু করে না। যার ফলে ডেনিয়েল অঙ্কুরে বিনাশ হতে চলেছে। গুনিলা ডেনিয়েলের মা–বাবার সঙ্গে দেখা করে, তার বিষয় আলোচনা করে, কিন্তু তেমন আশাপূর্ণ ফল না পেয়ে ফিরে আসে বাড়িতে। বাড়িতে এসে সাইমনের সঙ্গে ডেনিয়েলের বিষয়টি আলোচনা করে। আলোচনা শেষে তারা ডেনিয়েলের দায়ভার নেওয়ার এবং নিজেদের সন্তানের মতো লালন–পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা নিঃসন্তান বলেই সহজে এ সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

ডেনিয়েলের মা–বাবাকে প্রস্তাবটি দেওয়া মাত্রই তারা নারাজ হয় এবং অপমান বোধ করে। শেষে ডেনিয়েলকে সে স্কুল থেকে সরিয়ে দেশের বাইরে সুদূর আমেরিকায় অন্য এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। গুনিলা ডেনিয়েলকে মনে মনে তার মাতৃত্বের স্থানটিতে জায়গা করে দিয়েছে। ডেনিয়েলের শূন্যস্থান পূর্ণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। শেষে গুনিলা স্কুলের চাকরি ছেড়ে অনেক দূরে চলে যায়, ফলে সাইমন একা হয়ে যায়।

সাইমন কেন যেন বাধা দিল না গুনিলার যাওয়ার বেলায়। বরং সেদিন গুনিলাকে বলেছিল, ‘আমি তোমাকে প্রথম দেখেই পছন্দ করেছি, তোমাকে প্রথম দেখার পর বহিঃপ্রকাশ আমার চিত্রাঙ্কন, যা দেওয়ালে ঝুলছে। যদি তুমি সুখী হও অন্য কারও সঙ্গে তবে চলে যাও।’ গুনিলা সবকিছুর পরও বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। শূন্যতায় ভরা বাড়িতে বসে বসে সাইমন একের পর এক চিত্রাঙ্কনে ভরে ফেলতে লাগল তার গ্যালারি।
সাইমন নামকরা চিত্রশিল্পী, তার খ্যাতি শুধু দেশ নয়, বিশ্বজুড়ে জায়গা করে নিয়েছে। বছরখানেক যেতে হঠাৎ একদিন গুনিলা সাইমনের জীবনে ফিরে এল। সেই যে এল আর গেল না।

সাইমন হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। বয়স হয়েছে, কখন শেষ নিশ্বাসটুকু বেরিয়ে যায়, এমন অবস্থায় শুয়ে শুয়ে এসব গল্প করছে জেসিকার সঙ্গে। জেসিকা হাসপাতালে পার্টটাইম জব করে পড়ালেখার ফাঁকে। জেসিকার শখ চিত্রশিল্পী হবে, সাইমনের মতো একজন চিত্রশিল্পীর সেবা করা, তার জীবনের সমস্ত ভালো-মন্দ, হাসি-কান্না, প্রেম-বিরহের গল্প জানার সৌভাগ্য কয়জনের হয়? জেসিকা স্বাভাবিকভাবে সাইমনের সঙ্গে তার ব্যক্তিজীবনের অনেক কিছু শেয়ার করে। আজ জেসিকার মন খারাপ, খুব খারাপ। সাইমন বিষয়টি লক্ষ করেছে, কিন্তু কিছু জিজ্ঞাসা করছে না। এদিকে জেসিকাও কিছু বলছে না। একসময় সাইমন নিজ থেকেই বহু বছর আগে তার স্ত্রী গুনিলার সঙ্গে মান-অভিমান নিয়ে যে মনোমালিন্য হয়েছিল, তার ওপর গল্প করতে শুরু করে। গল্প শুনতে শুনতে কোনো এক সময় জেসিকাও তার ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে সাইমনের সঙ্গে আলোচনা করতে শুরু করে তার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে। জেসিকার বয়ফ্রেন্ড টমাস, সে একজন নামকরা বুল টামার।

বুল টামার কী
ষাঁড়ের ঘাড়ে বসে যে ষাঁড়কে নানাভাবে বিরক্ত করে, তাকে বুল টামার বলে। একটি নির্দিষ্ট সময় ষাঁড়ের প্রচণ্ড লাফালাফির পরও যদি বুল টামার ষাঁড়ের ঘাড়ে বসে থাকতে পারে, তখন সে জয়ী হয়। এটা একটি ভয়ংকর খেলা। অনেক সময় রাগান্বিত ষাঁড় যখন তার ঘাড় থেকে বুল টামারকে মাটিতে ফেলে, তখন শিং বা পা দিয়ে বুল টামারকে মেরে ফেলতেও দ্বিধা করে না। টমাসের বাবা একজন খ্যাতনামা বুল টামার ছিলেন। দীর্ঘ সময় ষাঁড়ের ঘাড়ে বসে ষাঁড়কে ক্লান্ত করতে যে পারদর্শিতার পরিচয় তিনি দিয়েছেন, সেটা ছিল বিরল। তবে অল্প বয়সেই কোনো একদিন ষাঁড়যুদ্ধের ময়দানে ষাঁড়ের শিঙের গুঁতোয় অকালে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। টমাস ঠিক বাবার পেশাটি বেছে নিয়েছে, যা টমাসের মাকে প্রতিনিয়ত স্বামীর অকালমৃত্যুর কথাই মনে করিয়ে দেয়। জেসিকা সাইমনের সঙ্গে সমস্ত কথা একের পর বর্ণনা করে চলছে। জেসিকা হারাতে চায় না টমাসকে যেমনটি হারিয়েছে টমাসের মা তার স্বামীকে। জেসিকা টমাসকে নিষেধ করেছে, সে যেন ষাঁড়যুদ্ধ প্রতিযোগিতা ছেড়ে দেয়। টমাস জেসিকার কথায় রাজি না হওয়ায় সম্পর্কের ইতি টেনেছে সে, যার ফলে জেসিকার মন খারাপ।

সাইমন মন দিয়ে সব কথা শোনার পর শুধু এতটুকুই বলে সেদিন জেসিকাকে, ত্যাগের মধ্যেও রয়েছে জীবনের ভালোবাসা তবে সবাই সেই ত্যাগ স্বীকার করতে পারে না। জেসিকা কাজ শেষে বাড়ি ফিরতে পথে টেলিফোনে জানতে পারে, সে নিউইয়র্ক আর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। এটা তার জন্য একটি খুশির খবর। টমাস যখন তার পেশা থেকে সরতে রাজি হয়নি, তখন সে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিউইয়র্কে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ঘটনাটি টমাসের মা জানতে পারে এবং টমাসকে নতুন করে বোঝাতে চেষ্টা করে। বাবা টমাস, ‘ষাঁড়ের পিঠে বড়জোর আট সেকেন্ড বা তার চেয়ে কিছু বেশি সময় বসে থাকা সম্ভব। কিন্তু জেসিকার সঙ্গে তোমার সারা জীবনের সম্পর্ক। সেখানে থাকবে পরস্পরের গভীর ভালোবাসা। সেটা চিন্তা করে তুমি ষাঁড়যুদ্ধ খেলা ছেড়ে দাও।’ টমাস মায়ের কথা সেদিনও রাখেনি।

যা হোক, চলছে জীবন যার যার গতিতে। জেসিকা নিউইয়র্কে গেছে। সাইমন পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। মৃত্যুকালে সে তার সমস্ত চিত্রাঙ্কন ডোনেট করেছে এক শর্তে, যেটা সাইমনের উকিলই শুধু জানে। এদিকে টমাস এই প্রথম ষাঁড়ের ঘাড়ে দুই মিনিট বসে ষাঁড়কে ক্লান্ত করে তখনকার সময় সর্বকালের সেরা রেকর্ড করেছে, যা জেসিকার নজর কেড়েছে নিউইয়র্কের একটি সংবাদপত্রের মাধ্যমে।

টমাসের এমন একটি আনন্দঘন মুহূর্তে সে মিস করছে জেসিকাকে। টমাস হঠাৎ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে ষাঁড়যুদ্ধ খেলা ছেড়ে দেবে। টমাস সাইমনের চিত্রাঙ্কনের গ্যালারিতে নতুন চাকরি নিয়েছে। চলছে জীবন তার নিজ নিজ গতিতে।

কিছুদিন যেতে সাইমনের উকিল নোটিশ দিয়েছে, সাইমনের সমস্ত সম্পত্তি নিলামে বিক্রি হবে মৃত্যুর আগে সাইমনের লিখে রেখে যাওয়া উইলের ভিত্তিতে। কী লেখা আছে এই গোপনীয় উইলে, সাইমোনের উকিল ছাড়া অন্য কেউ তা জানে না। বহু লোকের আগমন হয়েছে আর্ট গ্যালারিতে। নিলামে নামীদামি চিত্রগুলো বিক্রি হবে চড়া দামাদামির মাধ্যমে—এমনটি আশা নিয়ে সবাই সেদিন বসে আছে।

উকিল সাহেব এসে প্রথমে সাইমনের যে ছবিটি বিক্রি করার জন্য প্রস্তাব দিলেন, সেটা ছিল সাইমনের আঁকা সেই লেকের ধারে বসে গুনিলার পুরো দেহটার চিত্রাঙ্কন, যার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে মাত্র এক হাজার ডলার। প্রসঙ্গত, জেসিকা আর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, স্বাভাবিকভাবে সেও সেদিন এসেছে সাইমনের আর্ট গ্যালারিতে, তবে সে জানে না সেখানে টমাস কাজ করে। দামাদামি হচ্ছে না, কেউই আগ্রহ দেখাচ্ছে না গুনিলার ছবিটির জন্য। শেষে দাম কমতে শুরু করে।

কোনো একপর্যায়ে মাত্র ৫০০ ডলার ধার্য করা হয়, তারপরও কেউ গুনিলার ছবিটি কিনতে রাজি হচ্ছে না। জেসিকা জানে কী চমৎকার হৃদ্যতা ও স্মৃতি জড়িত এই পাথরে আঁকা ছবিটির মধ্যে। হঠাৎ পেছন থেকে একটি সুদর্শন যুবক হাত তুলেছে, নিলামে ৫০০ ডলারের বিনিময়ে গুনিলার ছবিটি কেনার জন্য। সবার নজর পেছনে, জেসিকা পেছনে মুখ ঘোরাতেই বিস্ময়ে হতবাক, আরে, এ তো সেই টমাস, যাকে সে একদিন ভালোবেসেছিল। হঠাৎ দেখে চমকে মুগ্ধ হয়ে থমকে যায় জেসিকা, টমাস কেন এখানে এবং কেনই–বা গুনিলার ছবিটি কিনল, যেখানে অন্য কেউ কোনো আগ্রহ দেখাল না! যা হোক, গুনিলার অঙ্কিত চিত্র টমাসের কাছে বিক্রি হয়ে গেল। পরবর্তী চিত্রাঙ্কনগুলো নিলামে দামাদামির অপেক্ষায় সবাই, এমন সময় উকিল সাহেব ১৫ মিনিট বিরতির ঘোষণা দিলেন। সবাই বসে আছে আর অপেক্ষা করছে পরবর্তী স্টেপের আশায়। এই ফাঁকে জেসিকা টমাসের সামনে এসে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে। টমাস জেসিকাকে দেখছে স্মৃতির জানালা খুলে।

কেমন আছ, জিজ্ঞেস করল জেসিকা।
-আমি ভালো আছি, তুমি?
-হ্যাঁ, আছি।
-তুমি এখানে? তুমি তো কখনো চিত্রাঙ্কন পছন্দ করতে না। তা হুট করে গুনিলার ছবি কেন তুমি কিনলে?
-তোমার কথা মনে করে।
-আমার কথা মনে করে, মানে?
-একদিন তুমি বলেছিল সাইমনের জীবনের ভালোবাসার কথা এবং গুনিলার সঙ্গে তার প্রথম দেখার স্মৃতি।
-তোমার সে কথা মনে আছে?
-হ্যাঁ।
-তা কীভাবে জানলে যে আজ সাইমনের সবকিছু নিলামে বিক্রি হবে?
-আমি এখানে কাজ করি।
এ কথা শুনে জেসিকা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-মানে? তোমার ষাঁড়যুদ্ধ?
-সেটা ছেড়ে দিয়েছি অনেক আগেই।
-ওহ!
হঠাৎ বিরতির সময় শেষ হয়ে গেল। সবাই যার যার জায়গায় গিয়ে বসতেই উকিল সাহেব সাইমনের লেখা উইলটি পড়তে শুরু করলেন, যে গুনিলার চিত্রাঙ্কন কিনবে, সেই আমার সমস্ত আর্ট গ্যালারির দায়ভার এবং মালিকানা লাভ করবে।
উকিলের উইলনামা পড়া শেষ হতেই সবাই হতবাক! বলে কী! কীভাবে এটা সম্ভব! নানাজনের নানা প্রশ্ন, কিন্তু উত্তর নেই কোথাও। তাহলে কি টমাস সব জানত? সে জানবে কী করে। সে আর্ট গ্যালারিতে চাকরি নিয়েছে সাইমনের মৃত্যুর পর।

জেসিকা নিঃশব্দে–নীরবে তাকিয়ে আছে টমাসের দিকে। টমাস জেসিকাকে জড়িয়ে ধরে শুধু বলল, তোমাকে ঘিরে ভালোবাসার জাল বুনেছিলাম। কিন্তু তোমাকে হারিয়ে শুধু অনুভবে স্মৃতিটুকু নিয়ে তোমার পছন্দের জায়গা সাইমনের আর্ট গ্যালারিতে চাকরি নিয়েছি। কারণ একটিই, হয়তো কোনো একদিন তুমি এখানে আসবে।
সাইমনের জীবনের ভালোবাসা ছিল তার গুনিলাকে ঘিরে আর টমাসের জীবনের ভালোবাসা হলো জেসিকার জন্য গুনিলার চিত্রাঙ্কন কিনে।

Full Video