পরিত্যক্ত টয়লেটে শিকল পায়ে ২০ বছর, নতুন জীবন কী পাবে শংকরী?

ভাঙাচোরা টিনের ছোট্ট একটি কুটির। বাঁশের সঙ্গে জিআই তারে বাঁধা কুটিরের টিনগুলো মরিচা পড়ে নষ্ট হয়েছে অনেক আগেই। এই টিনেই এক পাশে অল্প জায়গায় রাখঢাক করা হয়েছে চারপাশ। এখানে আসে না আলো-বাতাস কিংবা কোনো মানুষ।

দূর থেকে কিছু টের পাওয়া না গেলেও কাছে এলেই দুর্গন্ধে বন্ধ হয়ে আসে। দেখা মেলে এক ভয়াবহতার। টিনের এই কুটির মূলত পরিত্যক্ত একটি টয়লেট। ভেতরের বাঁশের মাচার ওপর কাঠের তক্তা পেতে জীবন কাটছে মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারীর।

পরিত্যক্ত এই টয়লেটটি তার বাসস্থান। কখনো বসে কখনো বা বালিশ তোশক বিহীন শুয়ে দীর্ঘ ২০ বছর ধরে শিকলে বন্দি শংকরী লাল গুহ (৪৫)। জীবন কী তা হয়তো স্মৃতিতে নেই শংকরীর।

তার ডান পায়ের গোড়ালির ওপরে লোহার শিকল দিয়ে তালা। অপর পাশ আবার বাঁধা হয়েছে টয়লেটেই আরেকটি মোটা বাঁশের সঙ্গে। দীর্ঘদিনের এই বাঁধনে পায়ে দাগ পড়েছে, শিকলেও ধরেছে মরিচা। তবুও এখানেই খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, পয়ঃনিষ্কাশনসহ চলে সবকিছুই।

দুর্বিষহ জীবন কাটানো শংকরীর বাড়ি নেত্রকোনার দুর্গাপুরে। পৌর শহরের আমলাপাড়া স্বর্গীয় শম্ভুলাল গুহের তৃতীয় সন্তান তিনি। এছাড়াও রয়েছে বড়ো দুই বোন, ছোট আরও একটি ভাই। প্রচণ্ড মেধাবী হয়েও এখন তার জীবন কাটছে চার দেয়ালে বন্দি হয়ে। পরনের কালো রঙের জামাটি পুরাতন হয়ে ছিঁড়ে হয়েছে কয়েক টুকরো। তা দিয়েই কোনরকমে ঢাকা শরীরটুকু। মাথার চুলগুলো শক্ত হয়ে বেঁধেছে জট।

মেধাবী এই শিক্ষার্থী শহরের বিরিশিরি মিশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের পড়ালেখা করেছেন দীর্ঘদিন। পড়াশোনাকালীন বাবার মৃত্যুতে থমকে যায় তাদের পুরো পরিবার। বাবার শোক কাটিয়ে মামার বাড়িতে থেকে বেশ কয়েকদিন পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলেও দরিদ্রতার কারণে নবম শ্রেণির গণ্ডি পেরোতে পারেননি তিনি।

পরে পড়াশোনা বন্ধ করে সংসারের কাজে মনোযোগ দেন শংকরী। ২০০১ সালে হঠাৎ করে একদিন নাকের সমস্যা দেখা দিলে কয়েকদিনের ব্যবধানে তা রূপ নেয় টিউমারে। পরিবারের সদস্যরা এর চিকিৎসা করে ভালো করলেও এরপর থেকে হঠাৎ করে অস্বাভাবিকভাবে পরিবর্তন হতে শুরু করে তার আচরণ। একপর্যায়ে পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।

এখান থেকেই শুরু তার বন্দিজীবন। পায়ের কখনো বা মোটা রশি কিংবা শিকল বেঁধে শুরু হয় আটকে রাখার চেষ্টা। পাগল মেয়েকে কোনরকম শান্ত রেখে সবসময় দেখাশোনা করতেন মা। ২০১৩ শেষের দিকে তিনিও চলে গেলেন। পরে পুরো সংসার ছোট ভাই জীবন লাল গুহের কাঁধে পড়ে। স্থানীয় একটি প্যাথলজিতে সামান্য পিয়নের চাকরি করে কোনরকম সংসার চালিয়ে গেলেও বোনের চিকিৎসার অর্থ যেন কোনভাবেই যুগিয়ে উঠতে পারেন না তিনি।

তাছাড়া পুরো বাড়ি জুড়ে ভাঙাচোরা টিনের এই একটিমাত্র ঘর। ঘরের দুটি রুমে গাদাগাদি করে থাকেন পাঁচ সদস্যের পরিবার। বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না পেয়ে বাড়ির পেছনে পুকুর ঘাটের সঙ্গে পরিত্যক্ত টয়লেটের ওপর টিনের বেড়া দিয়ে তার ভেতর রেখেন মানসিক ভারসাম্যহীন বোনকে।

এরপর থেকেই এর ভেতরেই নিঃসঙ্গ জীবন কাটাচ্ছেন শংকরী। সর্বদা নিশ্চুপ থেকে কুটিরের ভেতর লুকিয়ে রাখেন নিজেকে। অপরিচ্ছন্ন ও ছেড়া কাপড় পড়ে পার করছেন বছর পর বছর।

স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন ধরে আমরা শংকরীকে এভাবেই দেখছি। তাকে কখনোই বাহিরে আসতে দেখা যায়নি। এভাবে একটা মানুষ কতদিন বাঁচতে পারে! তার জন্য আমাদের অনেক কষ্ট হয়। তার ভাই ও অনেক গরিব মানুষ। আর্থিক সঙ্কটে বোনটিরও চিকিৎসা করাতে পারছেন না। এখন যদি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও সরকারের পক্ষ থেকে কেউ এগিয়ে আসেন তাহলেই হয়তো শংকরী আবারও নতুন জীবনে ফিরতে পারেন।

শংকরীর স্কুল জীবনের সহপাঠী শ্যামল রায় জানান, শংকরী অনেক মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। বেশিরভাগ সময় তিনি মামারবাড়ি শিবগঞ্জ থেকেই বিরিশিরি মিশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় পড়াশোনা করতেন। হঠাৎ করেই কি জানি হয়ে গেলো। পরিবারের সদস্যরা ছাড়াও অনেক চিকিৎসা করিয়েছেন তবুও তাকে ভালো করতে পারেনি। ভাই সংসারের বোঝা টেনে নিয়ে আর চিকিৎসা করতে পারেননি। সে খুবই মানবেতর জীবনযাপন করছে। বর্তমান সরকার তো অনেকেই মানুষকেই বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিয়ে সুস্থ করেছেন। তাকেও একটু ভালো চিকিৎসা দেওয়া যেতো, তাহলে সেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারতো বলে আমরা মনে করি।

শংকরী ভাই জীবন লাল গুহ জানান, হঠাৎ করেই আমার বোন অসুস্থ হয়ে গেছে। আমরা চিকিৎসা করিয়েছি। আজ প্রায় ২০ বছরের ওপরে হয়ে গেছে তার এই মানসিক সমস্যা। অনেক কষ্ট লাগে, কিন্তু কী করবো! আমার সামর্থ্য নেই। সামান্য একটা চাকরি করে তাদের কোনো রকমে সংসার চলে। নিজের ঘর ভেঙে পড়ছে। এখন তার জন্য একটা ঘর করে দেবো তারও কোনো ব্যবস্থা নেই। টাকার সঙ্কটে চিকিৎসা করতে পারতেছিনা। বিষয়টি নজরে আনা হয় উপজেলা নির্বাহী অফিসার রাজিব উল আহসানের।

বিষয়টা আমাদের জানা ছিলোনা, এইমাত্র জানলাম। মানবিক এই বিষয়গুলো নিয়ে আগে থেকেই সরকার কাজ করে যাচ্ছে। আমরাও রুট লেভেলে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা অবশ্যই পরিদর্শন করবো। মানসিক ভারসাম্যহীন শংকরী গুহের প্রয়োজনগুলো সরকারি স্কিমের ভেতর থেকেই তা ফুলফিল করার চেষ্টা করবো। প্রাথমিকভাবে তার বাসস্থানের জন্য টিনসহ প্রয়োজনীয় খাদ্য সহায়তা প্রদান করা যাবে। পাশাপাশি তিনি যদি বুদ্ধি প্রতিবন্ধি কিংবা মানসিক প্রতিবন্ধি হয়ে থাকেন তাহলে অবশ্যই সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে প্রতিবন্ধি ভাতারও ব্যবস্থা করে দেবো।

Full Video