টিকটক নিয়ে মামলার আসামি ১০৫, অপরাধীদের তথ্য চেয়েছে সিআইডি

বাংলাদেশে বেআইনি এমন কনটেন্ট প্রচার না করার ব্যাপারে টিকটকের সঙ্গে কথা বলেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ(সিআইডি)। তারা বাংলাদেশে টিকটক ব্যবহার করে অপরাধ সংঘটনকারীদের ব্যাপারে তথ্য চেয়েছে। সিআইডির অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক কামরুল আহসান প্রথম আলোকে এ বৈঠকের কথা নিশ্চিত করেছেন।

বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় গত বৃহস্পতিবার। সিআইডি সূত্র প্রথম আলোকে জানিয়েছে, সম্প্রতি ভারতের বেঙ্গালুরুতে নারী ও শিশু পাচারের ঘটনার পর থেকে সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছে, এমন কর্তৃপক্ষগুলো টিকটকের সঙ্গে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেয়। এর আগে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনও (বিটিআরসি) টিকটকের সঙ্গে কথা বলে। কিছু অপরাধের তদন্ত নিয়ে সিআইডি টিকটকের সঙ্গে জুম মিটিংয়ে বসে। ওই বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে, এ দেশের আইনে বৈধ নয় এমন কনটেন্ট আপলোড করার ক্ষেত্রে যত্নবান হওয়ার অনুরোধ জানানো হয়।

সিআইডি সূত্র প্রথম আলোকে বলে, টিকটককে বেআইনি কাজের তথ্য সরবরাহে অনুরোধ করেছে তারা। উদাহরণ হিসেবে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনের কথা বলেছে সিআইডি। এ আইনে কিছু বিষয়কে পর্নোগ্রাফির উপাদান বলে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য অপরাধের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের আইন অন্যান্য দেশের আইনের চেয়ে আলাদা হতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের টিকটকাররা আইন ভঙ্গ করছেন কি না, সেদিকে নজর রাখার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি ওই সূত্র আরও জানায়, টিকটক কর্তৃপক্ষের মনোভাব ইতিবাচক। তারা আরও জানিয়েছে, টিকটকের একটি কমিউনিটি গাইডলাইন রয়েছে। সেই নির্দেশিকা বাংলায় অনুবাদ করা হচ্ছে।

টিকটকের পক্ষে ওই বৈঠকে প্রতিষ্ঠানটির দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার পাবলিক পলিসি ডিরেক্টর মহিদ বানসাল নেতৃত্ব দেন। এর বাইরেও ওই বৈঠকে আরও দুজন উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের একজন আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক ও অপরজন আইনগত বিষয় দেখভাল করেন। এর আগে বাংলাদেশ কয়েকজন টিকটক ব্যবহারকারীর তথ্য চেয়েও পায়নি।

টিকটক চীনা প্রতিষ্ঠান বাইটড্যান্সের নিয়ন্ত্রণাধীন। একসময় এর গ্রাহক তালিকার বড় অংশ ছিল ভারতে। সেন্সরটাওয়ারের হিসাবে ভারত টিকটকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করার পরও এই মুহূর্তে সারা বিশ্বে ৩০০ কোটি আইডি থেকে এটি ব্যবহৃত হচ্ছে। ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসে ৩৮ কোটি ৩০ লাখ গ্রাহক প্রথমবারের মতো এই অ্যাপ ডাউনলোড করেছেন। ফেসবুক ও ফেসবুক–সংশ্লিষ্ট অ্যাপ, যেমন মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইনস্টাগ্রামের পরই এখন টিকটকের অবস্থান।

টিকটক তাদের ওয়েবসাইটে বলেছে, মানুষ যেন তাঁর সৃষ্টিশীলতার প্রকাশ ঘটাতে পারেন এবং একই সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পারেন, তা নিশ্চিত করাই এর উদ্দেশ্য। টিকটক গ্রাহকদের নিরাপত্তা দিতে চায়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে টিকটক ট্রান্সপারেন্সি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই প্রতিবেদনে তারা জানায়, ১ জুলাই থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা ৮ কোটি ৯১ লাখ ৩২ হাজার ৯৩৮টি ভিডিও সরিয়ে নিয়েছে। অ্যাকাউন্ট সরানো হয়েছে ৬১ লাখ ৪৪ হাজার ৪০টি। এই কনটেন্টগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কনটেন্ট ছিল নগ্নতা ও যৌনতাকে উসকে দেয়, এমন। সরিয়ে নেওয়া ভিডিওর ৮৮ দশমিক ৩ শতাংশই ছিল এ ধরনের ভিডিও।

সারা দেশে ১৩ মামলা, আসামি ১০৫

বাংলাদেশে ‘টিকটক’ ব্যবহারকারীদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি নানা ধরনের অপরাধের অভিযোগ উঠেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, টিকটক ব্যবহার করে অপরাধের দায়ে মামলা হয়েছে ১৩টি। এর মধ্যে ঢাকার বাইরে রাজশাহীতে দুটি এবং সিলেট মহানগর পুলিশের আওতাধীন শাহপরান থানা, সুনামগঞ্জ ও বরগুনায় একটি করে মামলা হয়েছে। এসব মামলায় আটজন গ্রেপ্তার হয়েছেন। আসামি ১০৫ জন।
প্রথম মামলাটি হয়েছিল আলোচিত টিকটকার ইয়াসিন আরাফাত অপুর বিরুদ্ধে। তাঁর বিরুদ্ধে মারধর ও বেআইনি সমাবেশের অভিযোগ উঠেছিল। বেশ কিছুদিন জেল খেটে বের হওয়ার পর তিনি এখন আবার টিকটকে সক্রিয় হয়েছেন। এরপর টিকটকারদের বিরুদ্ধে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে চারটি, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে পাঁচটি এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তিনটি মামলা হয়েছে।

ভারতের বেঙ্গালুরুতে নারী পাচারের ঘটনায় হাতিরঝিল থানায় চারটি মামলা হয়। বেঙ্গালুরুতে পাচার হয়ে দেশে ফিরে আসা এক কিশোরী প্রথম আলোকে বলে, অভিযুক্ত হৃদয় টিকটক করতেন। তাকে টিকটক মঞ্চে জনপ্রিয় হতে সাহায্য করবেন।

সে কারণে বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গায় গিয়ে ভিডিও ধারণ করতে হবে। টিকটক হৃদয় পরে তাকে কুষ্টিয়ায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ভারতে পাচার করে দেন। এর আগে গত বছর ভাটারা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা হয় দেওয়ান রসুল হৃদয়সহ দুজনের বিরুদ্ধে। তিনিও টিকটকে এক কিশোরীকে নায়িকা বানিয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে ধর্ষণ, যৌন হয়রানি করেন বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়।

কার দোষ, টিকটকের না ব্যবহারকারীর
গত জুনে এক বিতর্ক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে র‌্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুন বলেন, টিকটকসহ বিতর্কিত অ্যাপগুলো নিষিদ্ধ করার সময় এসেছে। তিনি আরও বলেন, টিকটক, লাইকিসহ বিভিন্ন মোবাইল অ্যাপ ব্যবহার করে যাঁরা অপরাধ করছেন, তাঁদের তালিকা হচ্ছে।

তবে তাঁর এই কথার সঙ্গে দ্বিমত করছেন টিকটক ব্যবহারকারী ও তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, সারা বিশ্বের বড় তারকাদের অনেকেরই টিকটক ভিডিও আছে। বাংলাদেশের তারকারাও এই দৌড়ে পিছিয়ে নেই। টিকটককে ঘিরে সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা হ্যাশট্যাগ হই সচেতন ক্যাম্পেইন শুরু করেছেন। তবে টিকটক ছেড়ে চলে যাননি।

টিকটকে অ্যাকাউন্ট আছে, এমন দুজনের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। তাঁদের একজন নাহিদা নিশা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে পাস করেছেন তিনি। নাহিদা প্রথম আলোকে বলেন, টিকটকে অভিনয়ের সুযোগ আছে, ঠোঁট মিলিয়ে সুন্দর ভিডিও করা হয়। তিনি অ্যাপটিতে ক্ষতির কিছু দেখেননি। ইদানীং এই অ্যাপের কিছু কনটেন্ট নিয়ে তাঁর আপত্তি আছে। এ জন্য যাঁরা কনটেন্ট বানিয়ে আপলোড করছেন, তাঁরা দায়ী।

অপর ব্যবহারকারী (অপ্রাপ্তবয়স্ক বলে নাম দেওয়া হলো না) দুটি আইডি দিয়ে টিকটক করে। একটি দিয়ে সে নিজে ভিডিও আপলোড করে ও অন্যটিতে তিন বন্ধু মিলে। তারাও টিকটকে শুধু ১৫ সেকেন্ডের ফানি ভিডিও আপলোড করে। অপরাধ হতে পারে, এমন কিছু করে না। কারও কারও মন্তব্য, অনেকেই টিকটকে লাইক বাড়িয়ে আয় করতে চান। তাঁরা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন বেশি।

দেশীয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বেশতোর প্রতিষ্ঠাতা ফাহিম মাশরুর প্রথম আলোকে বলেন, প্রযুক্তিকে কোনো গণ্ডিতে বেঁধে ফেলা অসম্ভব। একেক প্রজন্ম একেক ধরনের অ্যাপে স্বচ্ছন্দ বোধ করবে। এক প্রজন্ম ফেসবুক ব্যবহার করলে অন্য প্রজন্ম চাইবে আলাদা কিছু। অ্যাপ মানুষ নয়। তাই তার ভালো–মন্দও নেই। কে অ্যাপ ব্যবহার করছেন, সেটাই বিবেচ্য। অ্যাপ ব্যবহার করে অপরাধ ঘটানোর কিছু খবর বেরিয়েছে। সমস্যাটা হলো, বাংলাদেশের আইনি কাঠামোতে অ্যাপ কর্তৃপক্ষকে দায়বদ্ধ করার কোনো ব্যবস্থা নেই।

Full Video