ফিলিস্তিনের ইসলামি প্রতিরোধ আন্দোলন-হামাসের সামরিক শাখার প্রধান মোহাম্মদ যাইফকে হত্যার জন্য দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল। গত দুই দশকে এ নিয়ে তাকে হত্যার জন্য সাতবার বিফল চেষ্টা চালিয়েছে দেশটি।
বিবিসি জানিয়েছে, মোহাম্মদ যাইফকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলা এই ইঁদুর-বেড়াল খেলা নিয়ে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী হতাশ। সর্বশেষ লড়াইয়ের সময়েও তাদের লক্ষ্য ছিল হামাসের শীর্ষ এ সামরিক অধিনায়ককে হত্যা করা।
ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের প্রভাবশালী একজন নেতা সম্প্রতি ইসরাইলকে অশুভ পরিণতির হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন। তার অস্পষ্ট এক অডিও রেকর্ডিংয়ে বলা হয়েছিল, হামাসের দাবি মানা না হলে ইসরাইলকে ‘চরম মূল্য’ দিতে হবে।
এই অডিও রেকর্ডিংটি ছিল হামাসের সামরিক শাখার নেতা মোহাম্মদ যাইফের, কোনোভাবেই যার নাগাল পাচ্ছে না দখলদার বাহিনী।
ইসরাইলের ফেরারি তালিকায় মোহাম্মদ যাইফের নাম সবার ওপরে। গত সাত বছরের মধ্যে এই প্রথম তার কোনো কথা শোনা গেছে।
সম্প্রতি চলা লড়াইয়ে ইসরাইল মোহাম্মদ যাইফকেও হত্যার চেষ্টা করে, কিন্তু তাদের সে চেষ্টা বিফলে যায়।
ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনীর (আইডিএফ) মুখপাত্র হিডাই যিলবারম্যান নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, ‘এই পুরো অভিযান চলার সময় আমরা মোহাম্মদ যাইফকে হত্যার চেষ্টা করেছি।’
আইডিএফের কর্মকর্তারা বিবিসি-র কাছে নিশ্চিত করেছেন যে, মোহাম্মদ যাইফকে হত্যার জন্য অন্তত দুইটি চেষ্টা চালানো হয়। কিন্তু এবারও তাদের যাবতীয় প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
মোহাম্মদ যাইফ পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। বলা হচ্ছে, গত দুই দশকে ইসরাইল এ নিয়ে মোহাম্মদ যাইফকে হত্যার জন্য অন্তত সাত বার বিফল চেষ্টা চালিয়েছে।
কে এই মোহাম্মদ যাইফ
মোহাম্মদ যাইফ সম্পর্কে যতটুকু জানা যায়, সেটি মূলত ইসরাইলি এবং ফিলিস্তিনি পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে।
এসব রিপোর্ট অনুসারে, তার জন্ম ১৯৬৫ সালে গাজার খান ইউনিস শরণার্থী শিবিরে। গাজা তখন মিসরের দখলে। জন্মের সময় তার নাম রাখা হয়েছিল মোহাম্মদ ডিয়াব ইব্রাহিম আল-মাসরি।
কিন্তু ইসরাইলি বিমান হামলা থেকে বাঁচতে তাকে যেভাবে সারাক্ষণ যাযাবরের মতো জীবনযাপন করতে হয়, পরে তিনি পরিচিত হয়ে উঠেন ‘যাইফ’ নামে, আরবিতে যার অর্থ ‘অতিথি’।
বহু দশক ধরে চলতে থাকা ফিলিস্তিন-ইসরাইল সংঘাতের মধ্যে কীভাবে তিনি বেড়ে উঠেছেন, সে সম্পর্কেও জানা যায় খুব কম।
হামাস যখন প্রতিষ্ঠিত হয়, তখন মোহাম্মদ যাইফ একজন তরুণ। ১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে তিনি হামাসে যোগ দেন। হামাস ইসরাইলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চায়। দলটির সামরিক শাখা ‘ইজ্জুদ্দিন আল-কাসেম ব্রিগেড’-এ মোহাম্মদ যাইফ বেশ দ্রুত ওপরের দিকে উঠতে থাকেন। এভাবেই তিনি বেশ বিখ্যাত হয়ে উঠেন।
নয় বার প্রাণে বেঁচে গেছেন যেভাবে
ইসরাইলি নজরদারিকে ফাঁকি দেওয়ার ওপরই যেন নির্ভর করে মোহাম্মদ যাইফের জীবন। ২০০০ সালের পরবর্তী কয়েক বছরে তাকে হত্যার জন্য ইসরাইলিরা চার দফা চেষ্টা চালায়।
এর মধ্যে কয়েকটি হামলায় তিনি আহত হলেও পালাতে সক্ষম হন। ইসরাইলি রিপোর্ট অনুযায়ী, তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। শরীরের কয়েকটি অংশ উড়ে গেছে।
২০০৬ সালে ইসরাইলের হামলায় মোহাম্মদ যাইফ যে গুরুতর আহত হয়েছেন সেটা নিশ্চিত করেছেন আইডিএফের এক সাবেক গোয়েন্দা প্রধান।
তিনি বিবিসিকে বলেছিলেন, ‘লোকে ভেবেছিল মোহাম্মদ যাইফ আর নেতা হিসেবে বা একজন সামরিক পরিকল্পনাকারী হিসেবে কাজ করতে পারবেন না। কিন্তু খুব দ্রুতই তিনি সেরে উঠেন।’
ইসরাইলের এসব হামলা ব্যর্থ হওয়ার পর মোহাম্মদ যাইফের খ্যাতি আরও বেড়ে যায়। তাকে তার শত্রুপক্ষ বর্ণনা করতে থাকে ‘নয়বারের জীবন পাওয়া বিড়াল’ হিসেবে।
২০১৪ সালে গাজায় ইসরাইলের সামরিক অভিযানের সময় তার ওপর পঞ্চম হামলাটি চালানো হয়। গাজার শেখ রাদওয়ান এলাকায় একটি বাড়ির ওপর ইসরাইলিরা বিমান হামলা চালায়।
হামলায় মোহাম্মদ যাইফের স্ত্রী উইদাদ এবং তাদের শিশুপুত্র আলি নিহত হয়। ইসরাইলিরা ভেবেছিল, তারা মোহাম্মদ যাইফকেও হত্যা করতে পেরেছিল। কিন্তু তিনি আসলে তখন সেই বাড়িতে ছিলেন না।
ওই হামলার পরপরই হামাস জানিয়েছিল, মোহাম্মদ যাইফ এখনও বেঁচে আছেন এবং তিনিই হামাসের সামরিক অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।
নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মোহাম্মদ যাইফ যে বারবার ইসরাইলি সামরিক বাহিনীকে ফাঁকি দিতে পারছেন তার কারণ তিনি আধুনিক যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার একেবারেই এড়িয়ে চলেন।
মিস্টার লেভিট বলেন, ‘যদি আপনি ফোন ব্যবহার না করেন, কম্পিউটার ব্যবহার না করেন, তাহলে আপনি কোথায় আছেন, সেই ধারণা পাওয়া আধুনিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর জন্য খুব কঠিন হবে।’
ইসরাইলের সাবেক গোয়েন্দা প্রধান বলছেন, মোহাম্মদ যাইফকে হত্যার চেষ্টা যে ব্যর্থ হচ্ছে তার অনেক কারণ আছে। হামাসের টানেলগুলো যে রকম গভীর এবং বিস্তৃত এবং তার সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য এতো পুরনো, সেটা তাকে লুকিয়ে থাকতে সাহায্য করছে। এছাড়া কিছু হত্যা প্রচেষ্টার সময় অস্ত্র ঠিকমতো কাজ করেনি।